ভ্রমণ কাহিনী- যো কুছ্ হ্যাঁয় সব তু হি হ্যাঁয়

যো কুছ্ হ্যাঁয় সব তু হি হ্যাঁয় (তিরুপতি ভ্রমণ)
সুনির্মল বসু

কূপমন্ডুক আমি স্বপ্নেও কখনো ভাবি নি, কোনদিন তিরুপতি দর্শনে যেতে পারবো। উদ্যোগটা নিয়েছিল আমার ভাইঝি মোহর এবং বাড়ীর মেজো জামাই সিদ্ধার্থ। মার্চের এক সকালে নেতাজি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌছলাম। সঙ্গে ছিলেন আমাদের বেয়াইন, মোহর, সিদ্ধার্থ, আমার গিন্নী ও আমি। আগে থেকেই সিদ্ধার্থ বিমানযাত্রার টিকিট সংগ্রহ করেছিল। বিমানে যাবার পদ্ধতি মেনে ইন্ডিগো প্লেনে উঠে বসলাম। একসময় রানওয়ে ছাড়িয়ে আকাশ সীমানায় পাড়ি দিল বিমান। আগে একবার পুরীতে যাবার সময় আমরা ভুবনেশ্বর গিয়েছিলাম বিমানে চড়ে। সেবারের যাত্রা ছিল সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য। এবার কিন্তু পথটা অনেকটা দূর।

দীর্ঘ যাত্রায় আকাশে মেঘেদের রঙ বদল দেখতে দেখতে চললাম। পৃথিবীটা কত সুন্দর, ঈশ্বর যে কত বড় মাপের শিল্পী, মনে-মনে সেটা অনুভব করেছিলাম। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া হলো। একসময় আমাদের গন্তব্য এয়ারপোর্টে এসে পড়ল।

এয়ারপোর্টে নেমে আমরা একটি গাড়ি ধরে তিরুপতির দিকে এগিয়ে চললাম। সেখানে পৌঁছে আদর্শ রেসিডেন্সি নামে একটি হোটেলে গিয়ে উঠলাম।

আগে থেকেই সিদ্ধার্থ এই হোটেলটি ঠিক করে রেখেছিল। হোটেল কর্মীরা আমাদের লাগেজ তুলে দিল। পাশাপাশি দুটি ঘরে আমরা রাত কাটালাম। পরদিন গাড়ি ভাড়া করে চললাম তিরুমালা পর্বতের দিকে। যাবার পথে এক জায়গায় চেকপোষ্টে প্রতিটি গাড়ি চেকিং করা হচ্ছিল। আমরা গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। চেকিং শেষ হলে আবার গাড়িতে উঠলাম।

এখানকার পথঘাট এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, স্বপ্নের মত মনে হচ্ছিল। পথের দু’ধারে অজস্র ফুলের সমারোহ। চারদিকে ফুলেরা যেন আমাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য পথের দু’পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ডানদিকে পর্বতকে সাক্ষী রেখে আমরা ক্রমশ উপরের দিকে উঠছিলাম।

তিরুমালা পর্বতের উপরে রয়েছেন ভগবান তিরুপতি। সোনা দিয়ে সাজানো এই মন্দির। দর্শনার্থীদের ভীড় যথেষ্ট। জানতে পারলাম, এখানে প্রতিদিন কম করে এক লক্ষ ভক্তের সমাগম ঘটে।
এখানে অনেকেই চুল উৎসর্গ করেন।

দর্শনার্থীদের লাইনে বিশাল ভিড়। বিভিন্ন দিক থেকে লাইন মূল মন্দিরের দিকে গিয়েছে। আমরা পাঁচশো টাকার টিকিট কেটে লাইনে দাঁড়ালাম। ভক্তেরা মাঝে মাঝে
ভগবান তিরুপতির নামে জয়ধ্বনি করছিল।

পরিবেশ এমন, মনের মধ্যে কেমন যেন একটা পরিবর্তন টের পেলাম। মুগ্ধতা এবং ভক্তি একসঙ্গে মিলে মিশে গিয়েছিল। লাইনে ভিড় ছিল, কিন্তু কোন অশান্তি, ঠেলাঠেলি দেখিনি।

এক সময় আমরা দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করার পর তিরুপতি মন্দির এসে পৌছালাম। এক অপূর্ব অনুভূতি তখন মনের মধ্যে। বিশ্বাস হচ্ছিল না, সত্যিই কি আমরা তিরুমালা পর্বতের উপর ভগবান তিরুপতি মন্দিরে ঈশ্বরের পাদমূলে উপস্থিত হয়েছি। একটা স্বপ্নের ঘোরের মত মুহূর্ত। সারা জীবন কাজ আর কাজ। পৃথিবীতে এমন শান্তিময় ভুবন নিয়ে কখনো ভাবি নি। ঈশ্বরের অপার করুণায় আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছি।

মনে হল, শাশ্বত ভারতবর্ষের আসল ছবিটা দেখছি। কত অনাদিকালের ইতিহাস জমা হয়ে আছে এখানে।

যাওয়া-আসার পথে আমাদের ড্রাইভার সাহেব কি সুন্দর করে এখানকার স্থান মাহাত্ম্যের কথা বলছিলেন। পুজো ও প্রণাম সেরে একসময় নিচে নেমে এলাম। চারদিকে এত অপার সৌন্দর্য দেখেছি, কোন ভাবেই আমার দুর্বল ভাষায় সেটা বোঝাতে পারবো না। ফেরবার পথে সারাপথ আমার মনে হচ্ছিল, ঈশ্বর তো পাহাড়ের চূড়োতেই থাকেন।
আগে একবার অমরকন্টক যাত্রার সময় একজন সাধুবাবার সংলাপ মনে পড়ছিল,যো কুছ্ হ্যাঁয়, সব তুহি হ্যাঁয়।

তবে এখানে ভাষা একটি প্রধান সমস্যা। এখানকার মানুষ তামিল, তেলেগু ও মালায়লাম ভাষায় কথা বলেন। ওখানে হিন্দি বা ইংরেজি বলে সুবিধা করতে পারেনি। ওদের ভাষা কিছু মাত্র বুঝিনা।

আগের দিন রাতে লোকাল এরিয়া পরিদর্শন করতে বেরিয়ে, ওখানকার শপিংমলে ঘুরে পথের পাশে ডাব খেতে গিয়ে আকারে-ইঙ্গিতে বোঝাতে পেরেছিলাম, আমরা ডাব খেতে চাই।

হোটেলের খাওয়া-দাওয়া ভালো। কিন্তু সবকিছুতেই
টক বাধ্যতামূলক।

সন্ধ্যেবেলায় পথের পাশে প্রচুর ফুল বিক্রি হয়। এখানকার মেয়েরা সন্ধ্যেবেলায় ফুল সাজে সজ্জিতা হন। সন্ধ্যেবেলায় পথে বেরিয়ে দেখেছিলাম, বড্ড মায়াময় এবং স্বপ্নের মতো লাগছিল এই অঞ্চলটিকে।

লোকাল এরিয়া পরিদর্শনে গিয়ে ছিলাম তার পর দিন। তামিলনাড়ুর পথে কলকাতার চেয়ে ভীড় কম মনে হয়েছিল। কোথাও গাড়ির জ্যাম পাই নি।

অবশ্য সন্ধ্যেবেলায় শপিংমলগুলোতে ভীড় প্রায় কলকাতার মতোন। অল্পস্বল্প কেনাকাটা করেছিলাম। সন্ধ্যেবেলায় রেস্তোরাঁয় খাওয়া-দাওয়া করে হোটেলে ফিরেছিলাম।

পরদিন খুব ভোরে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে চড়ে কলকাতা ফিরেছিলাম। সকালে বলতে গেলে, চা-বিস্কুট ছাড়া কিছু খাওয়া হয়নি। দুপুরে খিদে পেয়েছিল খুব। কিন্তু এয়ার ইন্ডিয়া বিমান সেবিকারা সেদিন আমাদের দুপুরে খুব সুন্দর একটা লাঞ্চের ব্যবস্থা করেছিলেন। মনে মনে অজস্র ধন্যবাদ দিয়েছিলাম ওদের।

নেতাজি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করতেই, দেখা পেলাম ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটার ঝুলন গোস্বামীর। কথা হল, ছবি তোলা হলো।

বাইরে বেরিয়ে এলাম, ট্যাক্সির অপেক্ষায়। মনোরম স্মৃতি নিয়ে ফিরে এসেছি। চোখ বুজে মাঝেমাঝে তিরুমালা পর্বত দেখি, দেখি সেখানে সমাসীন ভগবান তিরুপতিকে।

ভগবান তিরুপতি হলেন আমাদের বিষ্ণুনারায়ণ। মনে মনে শতবার তাঁকে প্রণাম জানিয়ে বলি, সবার মঙ্গল করুন, হে পরমেশ্বর।

Loading

Leave A Comment